Magic Lanthon

               

আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদির ও সাবরিয়া সাবেরিন বাঁধন

প্রকাশিত ১০ জানুয়ারী ২০২৩ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

আর কোনো বসন্তে যেনো আগুন না লাগে

একজন শিল্পীর মৃত্যু-গন্ধ-ভরা কৌশিক গাঙ্গুলীর শব্দ

আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদির ও সাবরিয়া সাবেরিন বাঁধন

মরণের ধরন অজস্র। একেক জন একেক উপায়ে মারা যায়। শারীরিক মরণের বাইরেও আছে আরো হাজার রকম মরণ। কেবলমাত্র মরে গিয়েই অমর হতে পারেন মহান মানুষেরা। মরণের পরে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, টান, স্মরণ উপচে পড়ে বেশিরভাগ সময়। ফুলে, গানে, কবিতায়, ছবিতে মৃতের নাম, পরিচয়, কর্মের রঙ, সুবাস, সুর ইত্যাদি ছড়াতে থাকে। তবু, এতো কিছুর পরেও, মৃত্যু মানেই বিয়োগ, সমাপন, বিরহ, দাঁড়ি। কেবল জীব নয়, বিমূর্ত সবকিছু, জড়-জীবন, শিল্প, সময় সবকিছুরই বিনাশ আছে। সবখানেই মৃত্যু। এর মধ্যে শিল্প বা শিল্পীর মৃত্যু তুলনামূলক জটিল, দিনক্ষণ ধরে বের করা মুশকিল। শিল্পকে ছেড়ে গেলে বা যেতে হলে শিল্পীর একধরনের রুহুত্যাগ বা দেহত্যাগ ঘটে। আবার শিল্পীহীন শিল্পের হয়তো কখনো জন্মই হয় না।

কৌশিক গাঙ্গুলীর সাম্প্রতিক শব্দ (২০১৩) একটা মৃত্যু-ভিত্তিক, মৃত্যু-সচেতন চলচ্চিত্র। অথচ পুরো গল্পে কেউ মারা যায় না। শুধু একজন শিল্পী তার পরানপ্রিয় শিল্পকর্মের গভীরে ডুবে যেতে চান, দুনিয়ার আর সবাই তাকে টেনে বের করে নিয়ে আসে দূরে। একটা পর্যায়ে গিয়ে তার জীবন সেই শিল্পজগতের অনেক বাইরে চলে যায়। দেহ, চোখ, শ্বাস-প্রশ্বাস, হƒদযন্ত্র নিয়ে সে দিব্যি বেঁচে থাকে। তবু যেনো সমস্ত পর্দাজুড়ে মৃত্যু নামে। তবু যেনো মেঘবতী আকাশের নিচে... মৃত্যুর আয়োজন টের পাওয়া যায় কাকেদের ঘন কালো রঙে... ভালো মন্দের কাকশাস্ত্র থেকে কাকেরা উড়ে এসে জড়ো হয়েছে... নীলের ফোঁকর ঠুকে বেরিয়ে আসা কাক।

চলচ্চিত্র শুরু হয় এই সব কাকেদের কালো রঙ নিয়ে। ব্যাকগ্রাউন্ডে রাতের ট্রেনের শব্দ। অন্ধকার জমিনে মলিন সাদা রঙে ভেসে ওঠে উৎসর্গপত্র : A tribute to all those film technicians who never got their due recognition. Yet without their efforts a film would be a mere audio visual exercise.

চলচ্চিত্রের পিছনের মানুষদের গল্প নিয়ে তৈরি শব্দ। এর মূল চরিত্রে আছে film techniciansদের অন্যতম তারক দত্ত। সে কলকাতার চলচ্চিত্রের একজন ফলি আর্টিস্ট। নিখুঁত কাজ করতে ভালোবাসে, নিজের সবটুকু ঢেলে দিয়ে কাজ করে। নিজের কাজ বা শিল্পে অত্যধিক মনোযোগের কারণে তার স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয়। শিল্পপ্রাণ মানুষের শিল্পজগৎ আর বাস্তব জগতের চিরকালীন দ্বন্দ্ব ক্রমশই ঘনিয়ে ওঠে। ডাবিং পরবর্তী সময়ে নানা রকম শব্দ সে স্টুডিওতে বসে তৈরি করে। মানুষের মুখের কথার বাইরের অন্যান্য শব্দগুলোর সৌন্দর্য, মায়া খুঁজে পেতে থাকে দিনের পর দিন। চমৎকার, কাজে দারুণ দক্ষ এই মানুষটির বাস্তব জীবনে, সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ শব্দ, মানুষের মুখের কথা থেকে মনোযোগ চলে যায় অন্যান্য শব্দের দিকে। ওই শব্দগুলোই তার কাছে মুখ্য হয়ে ওঠে। উদ্বিগ্ন স্ত্রী তারককে নিয়ে যায় এক মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে। চিকিৎসক খুব মনোযোগী (অথবা অতি উৎসাহী) হয়ে তারককে বোঝাতে চেষ্টা করেন, এর কারণে অদূর ভবিষ্যতে অতি বড়ো কোনো সমস্যা হতে যাচ্ছে। তারক এই সমস্যা শব্দটিতে বিশ্বাস করতে চায় না। সে চায় আর দশজন শিল্পীর মতন সমস্ত মন-প্রাণ ঢেলে কাজ চালিয়ে যেতে। চিকিৎসক সমস্যার ভয়াবহতা নিয়ে তার সঙ্গে আরো কথা বলতে চাইলে, সে রেগে গিয়ে স্টুডিওর দামি মাইক্রোফোন ভেঙে ফেলে। ফলি আর্টিস্ট হিসেবে তার কাজের সেই শেষ। শিল্পী তারক শিল্পহীন, কর্মহীন মৃত্যুময় কানাগলিতে ঢুকে পড়ে।

 

আ.

দুনিয়ার সবকিছুরই জাত-ভেদ আছে। বিভিন্ন রকম শব্দের মধ্যে আছে ব্রাহ্মণ-শূদ্র ভেদ। এই ভেদ মানুষ সৃষ্ট। মানুষের মুখের ভাষা, গানকে এই জগতের সেরা শব্দ ধরে আর সব শব্দকে প্রথাগতভাবে মনে করা হয় নিচু স্তরের। জাঁক দেরিদা Logo-centrism-এর ধারণা দিয়ে দেখিয়েছেন, মানুষ মৌখিক শব্দকে স্বভাবত লিখিত শব্দের চেয়ে শ্রেয় মনে করে। আর এই লিখিত শব্দের চেয়েও হীনতর হলো বস্তুগত, অর্থহীন শব্দগুলো। অসংখ্য মৌমাছির গুঞ্জন বা স্রোতের গাঢ় শব্দের মধ্যেও কোনো মানুষের অনর্থক গলার স্বর ভেসে এলে তা-ই মুখ্য হয়ে ওঠে। তারকের বেলায় ঘটে উল্টো। যতোই দিন গড়াতে থাকে, ততোই তার কানে বেশি বাজতে থাকে অন্যান্য অর্থহীন শব্দ। সে এই শব্দগুলোর ভাষা খুঁজতে থাকে। হয়তো বুঝতেও পারে। তার কাছে শব্দ হচ্ছে ব্রহ্ম... (মানুষের) যেমন নিঃশ্বাস, ফিল্মে তেমনি শব্দ। অত্যধিক শব্দ ভক্তির ফলে সে স্ত্রী, বাবা, পরিচিতজনদের থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। অতি মনোযোগের ফলে কাজের মান আরো উন্নত হতে শুরু করে। জীবন পিছনে ফেলে সে আনমনে ডুব দিতে চায় শিল্পের মধ্যে, কাজের মধ্যে। কিন্তু সেই ডুব দেওয়া মানেই কেবল ডুব দেওয়া না। এই ডুব দেওয়ার অন্য মানে স্ত্রীর প্রতি অবহেলা, বাবার প্রতি অমনোযোগ, সংসার ত্যাগসহ নানান কিছু। সর্বোপরি অন্য সবার চোখে, বিশেষ করে চিকিৎসকের চোখে এটা একটা ভয়াবহ সমস্যা

শব্দতে দুই চিকিৎসক চরিত্রের মাধ্যমে সেই সমস্যার ভবিষ্যৎ আর কারণগুলো উঠে এসেছে। তারক মানুষের মুখের ভাষাকে প্রান্তিক আর অন্যান্য শব্দকে কেন্দ্রীয় ধরে নিয়েছে। চিকিৎসকের ভাষায়, তারকের শোনায় কোনো সমস্যা নেই; শ্রবণশক্তি ঠিকই আছে। কিন্তু শোনার পদ্ধতিতে একটা সমস্যা আছে। অতি শীঘ্র সে যদি সচেতন না হয়, যদি মানুষের কথার প্রতি পূর্ণ মনোযোগ ফিরিয়ে না আনে, তাহলে একটা বড়ো ধরনের বিপর্যয় তার জন্য অপেক্ষা করছে। এটা একটা রোগ। অদূর ভবিষ্যতে তার জীবনের আর কোনো অর্থ থাকবে না। অন্যান্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করার সব ক্ষমতা সে হারাবে। এবং সঙ্গে সঙ্গে অবশ্যই তার নিখুঁত কাজেরও অবনতি ঘটবে। আর কম মনোযোগের কাজ নিশ্চয়ই মান হারাবে। শিল্পের জায়গায় শিল্পীর আপোস কতোখানি কাম্য বা গ্রহণযোগ্য? চিরায়ত সেই দ্বন্দ্ব। শিল্পী কতোখানি সামাজিক মানুষ আর কতোখানি শিল্পপ্রাণ জীব? কবি, চিত্রকর, গায়িকা-গায়কসহ সমস্ত শিল্পীকে এই কঠিন প্রশ্নের মুখে দাঁড়াতে হয়। তারক যেহেতু একজন শিল্পী, তাই তাকেও বিভক্ত হতে হয়। শিল্প আর সমাজ দুইজনই তার কাছ থেকে মনের সিংহভাগ দাবি করে। সমাজের জয় হয়। শিল্পী তারকের মরণ হয়ে একজন বিশুদ্ধ সামাজিক তারকের জন্ম হয়। ফলি আর্টিস্ট তারক শেষমেশ একটা বিমা কোম্পানির চাকরিতে ফিরে যান।

 

ই.

When Gregor Samsa woke up one morning from unsettling dreams, he found himself changed in his bed into a monstrous vermin.

শিল্পীরা সাধারণত চালাক হয়ে চলতে পারেন না। দুই কূল রক্ষা করে চলতে গেলে শিল্প মিথ্যা হয়ে পড়ার ভয়ে হোক আর ভুবনভোলা হওয়ার জন্যেই হোক, তারকের মতন শিল্পীরা শিশু বা বৃদ্ধের মতন দুর্বল, নমনীয়। ঝড়ের বাতাস, শিলাবৃষ্টি বা কড়া রোদ থেকে বাঁচার শক্তি তাদের থাকে না। অতিমাত্রায় সংবেদী তারকেরা তাই হারিয়ে যায়, স্রোতে-ঝড়ে ভেসে যায়।

তারকের শিল্পীসত্তার মৃত্যুর পিছনে অন্য একটা (বলতে গেলে সবচেয়ে বড়ো) কারণ হলো তার প্রাপ্য সম্মান ও সম্মানীর অভাব। প্রথমটা মানসিক, পরেরটা অর্থনৈতিক। কিন্তু দুই-ই প্রায় সমান গুরুত্বের। তারক মনে করে, তার কাজ একটা অসাধারণ শিল্প, স্টুডিওতে বসে বাস্তব জীবনের নানান শব্দ অন্য উপায়ে তৈরি করা। পরমানন্দে সে করতে থাকে কাজ। যেমন শুকনো পাতার শব্দ দিয়ে পায়রার উড়ে যাওয়ার শব্দ সৃষ্টি করাঅবিকল মিলে যায়। এ সত্যিই অতুলনীয় এক শিল্প। কিন্তু সব প্রযোজক, নির্মাতারা ফলি আর্টিস্টকে আর্টিস্ট মনে করেন না, কারো কারো কাছে এটা নেহায়েত শ্রমিকের কাজ। শিল্পীকে প্রতিস্থাপন করা যায় না, কিন্তু শ্রমিক প্রতিস্থাপন যোগ্য। তাই তারক যখন মাইক্রোফোন ভেঙে ফেলে, তাকে প্রতিষ্ঠান থেকে বলা হয়, তুমি পাঁচশোটা ছবির ফলি করলেও এই মাইক্রোফোনটার দাম উঠবে না, তারক।

তারক তার প্রাপ্য বা প্রত্যাশিত সম্মান পায় না। বরং সব শ্রমিকের মতন তাকে কষ্টেসৃষ্ট শিল্প থেকে আলাদা করে ফেলা হয়। আবার সম্মানীও সে ঠিক মতন পায় না। ঘরের অভাব, তার স্ত্রীর কথা ও বাবার অসহায় মুখের মাধ্যমে স্পষ্ট বোঝা যায়। অথচ ২০২৫ জন অভিনয়শিল্পীর ফলি তিনি একা করেন। প্রাপ্য তার অনেক বেশি হওয়ার কথা। একই সঙ্গে অবহেলায় এবং অতি যত্নে তার শিল্পীজীবনের সমাপন হয়। মনোরোগ চিকিৎসককে অতি উৎসাহী মনে হয়। সে তারকের পিছনে লেগে থাকে। তুমি অসুস্থ, তারক, There's indeed a problem, একটা সমস্যা আছেবারবার এসব বলতে বলতে সে তারকের মানসিক জগতে একটা বড়ো রকমের ধাক্কা দেয়। এসবের আগে অন্তত তার মনে কোনো অতৃপ্তির বেদনা বা অস্থিরতা ছিলো না। চিকিৎসক তাকে নির্বিবাদ, নিরবচ্ছিন্ন কাজের জগৎ থেকে টেনে বাইরে নিয়ে আসতে চেষ্টা করে, সফলও হয়। ডাঙার মাছের মতন তারক মরণ-যন্ত্রণায় ছটফট। কিন্তু তারক চায় অমরত্ব। শব্দগুলো তার কাছে কেবল শব্দ না, দৈহিক মরণের পরেও বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। আমি মরে যাবো, আমার শব্দগুলো তো থাকবেএকজন শিল্পীর এর চেয়ে বড়ো কোনো স্বপ্ন থাকতে পারে না। সেই স্বপ্ন সফলের একমাত্র উপায় কেড়ে নিলে, স্বপ্নহীন চোখ জীবনহীন হয়ে পড়ে থাকে।

একটা পরাবাস্তব দৃশ্য আছে ছবিতে যা প্রাসঙ্গিক, এখানে উল্লেখ্য। অন্য একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। সম্ভবত তারককে যিনি দেখেন, সেই চিকিৎসকের গুরু। উনার কাছ থেকে ওই চিকিৎসক তারক সম্পর্কে পরামর্শ নিয়ে থাকেন। বয়সী লোকটি বিলিয়ার্ডের লাল বল হিট করলেন। বল গন্তব্যে গেলো, কিন্তু থামছে না। একটা অচেনা পথে নেমে যাচ্ছে গভীরে, আরো গভীরে। ভয়াবহ সেই পথের অন্যপ্রান্তে রোদে জ্বলা সমুদ্রসৈকত। আধোজলে চোখ বুজে শুয়ে আছে তারক। খানিক বাদে উঠে এসে বালিতে দেখতে পায় সেই লাল বিলিয়ার্ড বল। অদ্ভুত সৈকত। ভাঙা তাকে পুরনো জুতা; টেবিল চেয়ার পরিত্যক্ত, পড়ে আছে হাঁটুজলে; মোটরবাইক, হ্যাঙারে ঝুলানো কাপড়; আর আছে সেই ভাঙা মাইক্রোফোন। আচানক সেখানে এসে হাজির বিলিয়ার্ড খেলোয়াড়, সেই বয়সী বিশেষজ্ঞ। দানবিক ভঙ্গিতে বললেন, দাও। যেনো তারকের সর্বস্ব কেড়ে নিতে এসেছেন। ভয়ার্ত তারক নির্বাক। বলটা দাও। তারক বলটা হাতে তুলে দেয়। যেনো স্বপ্নের অবলম্বন তুলে দিলো অন্যের হাতে। এরপর তারক আর শব্দকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার মারণাস্ত্র ছুঁড়লেন তিনি। বিষ-তীরের মতন ভয়াবহ সুরে বললেন, এবার থেকে আর শব্দ নয়। No more sound.

তারকের রূপান্তর ঘটে। আশা, আত্মবিশ্বাস, শব্দ নিয়ে যতো গর্ব সব মিলাতে থাকে অন্ধকারে। চোখ মেলে তাকায় শিল্পহারা, আশাহীন অন্য কেউ। স্ত্রীর চোখে চোখ রেখে তার চোখ কেঁদে ওঠে। জানালার ফাঁকে বাবা এসে দাঁড়িয়ে আছে। কারো মুখে কথা নেই। সমস্ত মন চোখে এনে তারক দুঃখ ছড়ায়।


ঈ.

যে কবিতা লেখে সে কবিতা নিয়ে ভাববে, তো যে গান করে সে সুর নিয়ে ভাবে। যে ছবি আঁকে সে রঙ নিয়ে ভাবে, আর আমি শালা অন্য কিছু ভাবলেই আমার অসুখ।

তারকের মনের ভিতর আরেক জগৎ। তার মুখের এই কথাগুলোর মানে হলো, সে প্রচলের বাইরেও আরেক শিল্পজগৎ নিয়ে চিন্তা করে। যেখানে নানান রকম শিল্পীতে, বিভিন্ন শিল্পে কোনো বিভেদ নাই। একটা অন্যরকমের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির স্বপ্ন দেখে সে। সে তার কাজের, পরিশ্রমের, শিল্পের সত্যিকারের মূল্যায়ন, স্বীকৃতি চায়। সে চায় আর দশজন অভিনেতামিঠুন, দেব, জিৎদের মতন তার কষ্টসাধ্য, রাতজাগা, অভিনব অভিনয়েরও নাম ছড়িয়ে পড়ুক। শব্দশিল্পী তারককে চিনুক লোকে এক নামে। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে নানান জায়গায় মানুষ তার নাম জানুক। মরণের পরেও তাকে মানুষ যুগ যুগ মনে রাখুক। সে একজন কবির মতন সংবেদনশীল; একজন সঙ্গীতপ্রণেতার মতন শব্দ সচেতন; একজন আঁকিয়ের মতন রঙিন।

এই স্বপ্নময়, আশাদায়ক কথাগুলো কৌশিক গাঙ্গুলীর চলচ্চিত্রে স্পষ্ট করে বলা নেই। তবে স্বপ্নের মৃত্যুর কথা স্পষ্ট। মৃত্যু মানেই জীবনের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেওয়া। তাই শব্দ-তে তারকের আহত, নিহত স্বপ্ন উঠে এসেছে। স্বপ্নের পথে যদি কোনো বিপত্তি না আসতো, যদি সমান্তরালে চলে যেতো তারকের মনের আর বাইরের জগৎ, যদি এমন হতো :

বর্ষসেরা ফলি আর্টিস্ট হিসেবে এই বছর পুরস্কার জিতে নিলেন তারক দত্ত। জাতীয় পুরস্কার এ নিয়ে দুবার পেলেন তিনি। রাতে টেলিফোনে তাকে যদিও জানানো হয়েছে, তবু সকালের চায়ের কাপ এক হাতে নিয়ে তিনি ভাবছিলেন টিভি ছেড়ে খবরটা নিশ্চিত হবেন। চায়ের কাপ রাখতে গিয়ে আবারো মনে পড়লো, সেই দিনের কথা। তিনি সেদিন বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। চা খাওয়া সবে শেষ হয়েছে। কাপটা রাখতে গিয়ে খেয়াল করলেন খালি কাপ রাখলে একটা ফাঁপা শব্দ হয়। ভরা কাপের শব্দ থেকে একদম আলাদা। অথচ দিনের পর দিন ফলি আর্টিস্টরা খেয়াল না করে একই রকম শব্দে দুই কাজ করে যাচ্ছে। রেকর্ডিস্ট দিব্যেন্দু এলে তাকে বুঝিয়ে বললেন মি. দত্ত। আবার নতুন করে রেকর্ড হলো খালি চায়ের কাপের শব্দগুলো।

ওই একই ছবির, যেটার জন্যে প্রথম জাতীয় পুরস্কার পান, ফলি রেকর্ডিং চলে তখন। আরো একদিনের ঘটনা। এক ঝাঁক পায়রা উড়ে যাওয়ার শব্দ কীভাবে স্টুডিওতে করা যায় এ নিয়ে পরিচালক, দিব্যেন্দু সবাই চিন্তিত। তারক সবাইকে আশ্বস্ত করলেন, ঠিকই একটা কোনো উপায় বের হয়ে যাবে। নিজের মেধার ওপর তখন বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করেছে। সঙ্গে আছে চলচ্চিত্রের কাজের প্রতি সুগভীর টান। পরদিন বিকেলে হাঁটছিলেন পার্কের পথে। মাথায় তখনো সেই পায়রার পাখার শব্দ নিয়ে চিন্তা। বসন্ত তখনো আসেনি বোধ করি। পার্কে খানিক শীতের আমেজ। অজস্র পাতা মরে পড়ে আছে। কী মনে করে দুটো বড়ো শুকনো পাতা দুই হাতে তুলে নিলেন। শব্দশিল্পী তো, তাই শব্দ শুনতে ভালোবাসেন সবার চেয়ে বেশি। কানের কাছে নিয়ে পাতা দুটো নাড়ালেন। কী জানি মনে হলো! চোখ দুটো বন্ধ করলেন। আবার নাড়তে লাগলেন পাতা দুটো। হঠাৎ খেয়াল হলো, এক ঝাঁক পায়রা উড়ে যাওয়ার সঙ্গে এই শব্দ অনেকখানি মিলে যায়। যখন রাতে স্টুডিওতে রেকর্ড হলো শুকনো কয়েকটা পাতার শব্দ, পায়রার উড়ে যাওয়ার দৃশ্যে যখন বসানো হলো, এতো সুন্দর মিলে গেলো শব্দ আর ছবি যে, পরদিন থেকে তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ রেকর্ডিস্ট, পরিচালকসহ সবাই। পেলেন বর্ষসেরা শব্দশিল্পী হিসেবে জাতীয় পুরস্কার। পুরস্কার গ্রহণের দিন পিতা আর স্ত্রীর চোখে দেখতে পেলেন আনন্দাশ্রু। শিল্পী তারকের ব্যক্তিজীবনে, সেও আরেক মহান অর্জন।

আজকে বৈঠকখানায় বসে পত্রিকা হাতে তুলে নিলেন। বাংলা আর ইংরেজি দুই দৈনিকেই তাকে নিয়ে রঙিন ফিচার ছাপা হয়েছে। সঙ্গে পুরস্কার প্রাপ্তির খবর তো আছেই। ভোরে খবরের কাগজের শব্দটা তারককে ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চায়ের চেয়েও অধিক মুগ্ধ করে। পর্দা সরানোর শব্দ। মাঝে মাঝে তার কেনো জানি মনে হয় সূর্যের আলো, ফুলের গন্ধ এসবেরও শব্দ আছে। আমরা শুনতে পাই না ঠিক করে। সাধনা করে একদিন সেই দূরে পৌঁছাতে চান তারক দত্ত, যখন এই সব না জানা শব্দও তিনি আবিষ্কার করে ফেলবেন। একজন শিল্পীর পাশাপাশি এক বিশাল আবিষ্কারক হিসেবে তার নাম ধ্বনিত হবে দিকে দিকে।

 

উ.

কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টা করল সে। কিছু একটা শব্দ। কিন্তু কিছুই শোনা গেল না। বাতাসের বা পাতা ঝরার শব্দকোন কিছুই তার কানে এল না।

স্বপ্ন যে কেবল স্বপ্নই থেকে যায়; তারকের ভাব, ভক্তি, ত্যাগ কোনো কিছুই কারো চোখে পড়ে না। কতোটা গভীর হলে একজন মানুষ খালি আর ভরা কাপের শব্দে বিভেদ করতে পারে, কতোখানি অভিনব আর কৌশলী হলে একজন মানুষ শুকনো পাতার শব্দকে পায়রা উড়ে যাওয়ার শব্দে রূপ দিতে পারেকেউ বুঝতে পারে না।  তারকের শোনা শব্দ অন্য মানুষেরা কান পেতেও শুনতে পারে না। অনায়াসে বোধগম্য হওয়ার কথা মনের আকুতি, কেউ তা বুঝতে পারে না। আসলে তারকের সমস্যা কোথায়, কী তার আসলে প্রয়োজন তা কেউ বুঝতে পারে না। তার স্ত্রী, চিকিৎসক, দিব্যেন্দু সবাই মনে করে মানসিক রোগীর মতন করে তারকের চিকিৎসা করতে হবে। অত্যধিক শব্দপ্রেমিক, শব্দের ঘোরে থাকা এই মানুষটি কেবল নিজেই তার প্রয়োজন বুঝতে পারে। সে একাই কেবল জানে তার সমস্যা কোথায়।

একটা জায়গায় এই ছবি ভালো লাগেনি। সেটা হলো, অতি বৈজ্ঞানিক, মনোবৈজ্ঞানিক, যৌক্তিকভাবে তারকের সমস্যার বিশ্লেষণ করার চেষ্টা। খুব মনোযোগী হলে যদিও বোঝা যায়, পরিচালক একজন শিল্পী তারককে এই সব প্রথাগত বা যুক্তিভিত্তিক বাধ্যবাধকতার বাইরে নিয়ে যেতে চেয়েছেন। শেষের দিকে অবশ্য চিকিৎসক তারকের ব্যাপারটা অনেকটা বুঝতেও পারেন। মানুষের মুখের কথার বাধ্যবাধকতামূলক শ্রেষ্ঠত্ব নিয়েও তিনি প্রশ্ন তোলেন, ও (তারক) তো কারো কথা শুনছে না... কিন্তু Sensible কথা, শোনার মতো কথা কজন মানুষ বলছে। তবুও খুব বৈজ্ঞানিক, বিস্তারিত ব্যাখ্যা ছবিতে বারবার চলে আসায় মনে হয়েছে, তারকের অবচেতন মনের শব্দপ্রেম, সৃষ্টিশীলতা কেনো যেনো যুক্তির দুনিয়ার কাছে পরাজিত হয়ে যাচ্ছে। শেষের দিকে যখন অনেক বেশি ঘুমের ওষুধ খেয়ে তারক হাসপাতালে, তখন সেখানে দেখানো হয় ওই হাসপাতালের এক চিকিৎসকের ট্যারা চোখ। ছোটোবেলায় পাথর লেগে ডান চোখের মণিটা খানিক ডানে সরে যাওয়াতে তার চোখে সমস্যা শুরু হয়। তিনি একই সঙ্গে যেকোনো কিছু বা যেকোনো মানুষের দুইটা ইমেজ দেখতে পান। ধীরে ধীরে মানিয়ে নিতে শুরু করেন। ডান চোখটা সারাক্ষণ ঢেকে রাখতে রাখতে, ডান চোখের ইমেজটাকে ধীরে ধীরে অগ্রাহ্য করে বামচোখের ইমেজটাকেই তিনি এখন আসল ধরে নেন।

তারকের মানসিক চিকিৎসক, তারককে খানিকটা বুঝতে পারার পরেও কেনো যেনো অনেকটা স্ববিরোধীর ভঙ্গিতে, এই চোখের উদাহরণকে তারকের শব্দ সমস্যার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। উনি বোঝাতে চান যেতারকের ক্ষেত্রে আসলে মানুষের ভাষা আর অন্যান্য শব্দগুলোর ফোকাসিং নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে। সাধারণ, স্বাভাবিক মানুষেরা মানুষের মুখের কথাকে ফোকাসে রেখে অন্যান্য যাবতীয় শব্দকে ব্যাকগ্রাউন্ডে নিয়ে যায়। অন্যদিকে তারক গৌণ শব্দগুলোকে ফোকাসে এনে, মানুষের ভাষাকে ব্যাকগ্রাউন্ডে নিয়ে যাচ্ছে। তাই তারককে অন্যান্য শব্দ থেকে দূরে নির্জন স্থানে রাখতে হবে বহুদিন। সেখানে তাকে বাধ্য করা হবে কেবল মানুষের কথা শুনতে। যতোক্ষণ জাগবে গল্প, নিউজ, আলোচনা শোনাতে হবে।

এরপর একটা পুনর্বাসন কেন্দ্রে তারককে রাখা হয়। ৪৬৮ দিন পরে সে সেরে ওঠে। ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কাজে ফিরে যায়। কোনো রকম আবহসঙ্গীত বা শব্দ ছাড়া, শব্দ নীরবে শেষ হয়। ছবির শেষে ক্রেডিটলাইন ভাসতে থাকে শিল্পীর মরণের শোকে, কালো পর্দায়।

আরেকভাবে ভাবতে গেলে মনে হয়, চলচ্চিত্র শব্দর মূল চরিত্র হলো শব্দ নিজেই। উপেক্ষিত অসংখ্য শব্দ একসঙ্গে বিয়োগান্ত এই কাহিনীর একজন নায়ক। অন্ধকারে চলা ট্রেনের শব্দে ছবির শুরু, শব্দহীনতায় শেষ। যেনো শব্দের জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বলে যাওয়া এক কাহিনী। তারকই একমাত্র জন, যে এই সমস্ত শব্দকে ভালোবাসে, খুঁজে বেড়ায়। পিতা বা মাতা যেমন সন্তানকে নিজের জীবনের চেয়ে আপনার মনে করেন, তারক তেমনি নিজের মুখের ভাষার চেয়েও অধিক ভালোবাসে নানান রকম শব্দকে। যেমন, একবার এক বন্ধুমতন কোনো একজনের সঙ্গে নিজের কাজের গল্প করছিলো তারক।

মহাগুরু দেখেছিস?

মহাগুরু?

ওই যে, মিঠুন দা ফার্স্ট গাড়ি থেকে নেমে এসে দাঁড়ালো, খাটাস করে; ওটা কার সাউন্ড?

কার, তোর নাকি?

ওইটা আমার করা তো। মিঠুন দা, দেব, জিৎ... সবার সঙ্গে কাজ করেছি। ক্লাস টুয়েল্ভ পাশ করার পর থেকে কাজ করছি।

হঠাৎ চায়ের কেটলির নিচে আগুনের শব্দ, কাপে চা ঢালার শব্দ, রাস্তায় এক বালকের খেলনা চাকার শব্দের দিকে তারকের মন ছুটে যায়। ঢাকা পড়ে যায় তার নিজের গল্প। আশ্রয়হীন অসহায় শব্দগুলো তাই তারককে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়একজন সমঝদার, নির্ভরশীল মানুষ পেয়ে তারা বিবেচিত হওয়ার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু তারক কতোখানি নির্ভরশীল, কাউকে বাঁচানোর ক্ষমতা তার কতোখানি?

শব্দকে অধিক ভালোবেসে সে ধীরে ধীরে নিজেকে ধরে রাখার, তার শিল্পী সত্তাকে বাঁচিয়ে রাখার সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলে। স্রোতের বিপরীতে চলার মতন শক্তি সে জড়ো করতে পারে না। তাকে ঘিরে লতার মতন বাড়তে থাকা শব্দগুলোকে সঙ্গে নিয়ে শব্দশিল্পী পরাজিত হয় খরস্রোতা নদীর কাছে। একটা সময়ে গিয়ে, শব্দসহ শিল্পীর সলিল সমাধি হয়। মৃত্যু। হাতে হাত রেখে স্রোতে ভাসা দুইজন পরাজিত হয় সমস্ত প্রতিষ্ঠিতের কাছে।

কি করে কে জানে একদিন এক কাঁঠাল পাতা আর মাটির ঢেলার মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। কাঁঠাল পাতা মাটির ঢেলাকে বললো, যেদিন বৃষ্টি নামবে সেদিন আমি তোমায় ঢেকে রাখবো আর মাটির ঢেলা কাঁঠাল পাতাকে বললো, যেদিন ঝড় উঠবে সেদিন আমি তোমায় আটকে রাখবো। তারপর দিন যায়। বৃষ্টি এলে কাঁঠাল পাতা ঢেকে রাখে মাটির ঢেলাকে আর ঝড় উঠলে মাটির ঢেলা আটকে রাখে কাঁঠাল পাতাকে। কিন্তু একদিন কি যে হলো, একই সাথে শুরু হলো ঝড় আর বৃষ্টি। ঝড়ে কাঁঠাল পাতা উধাও হয়ে গেল আকাশে আর বৃষ্টিতে মাটির ঢেলা আবার হারিয়ে গেল মাটিতে।

 

আর কোনো সুন্দর শব্দ যেনো মরে না যায়,

আর কোনো বসন্তে যেনো আগুন না লাগে।

যে সমস্ত চোখ খুব ছোটো, কিছু মরে গেলে জলে ভরে,

যে সমস্ত মানুষেরা পাতা ঝরে যাওয়ার শব্দে ব্যাকুল হয়,

অতি ক্ষুদ্র সব সৌন্দর্যে যাদের মন ভরে যায়,

তাদের জয় হোক।

 


লেখক : আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদির ও সাবরিয়া সাবেরিন বাঁধন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে সম্প্রতি স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন।

muktadir137@gmail.com

sabriasaberin@yahoo.com

 

তথ্যসূত্র

১. দীন, সেলিম আল (২০০৮ : ১৪৫); ধাবমান; জাগৃতি প্রকাশনী, ঢাকা।

২. উৎসর্গপত্র, শব্দ; পরিচালনা : কৌশিক গাঙ্গুলী; ব্যান্ড ভ্যালু কমিউনিকেশন্স, ২০১৩।

৩. Selden, Raman, et. al. (1997 : 171); ‘Poststructuralist Theories : Jacques Derrida; A Reader’s Guide to Contemnporary Literary Theory; Prentice Hall, Harlow.

৪. Kafka, Franz (1996 : 3); The Metamorphosis; Trans : Stanley Corngold; W.W. Norton & Company, New York.

৫. হক, হাসান আজিজুল (২০০৮ : ১০১); পরবাসী; শ্রেষ্ঠ গল্প; বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ঢাকা।

৬. শাহাদুজ্জামান (১৯৯৬ : ৮); এক কাঁঠাল পাতা আর মাটির ঢেলার গল্প; কয়েকটি বিহ্বল গল্প; মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা।

 


 বি. দ্র. এ প্রবন্ধটি ২০১৪ সালের জানুয়ারির ম্যাজিক লণ্ঠনের ষষ্ঠ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ করা হয়।



এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন